আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে নির্বাচনি প্রচারণা। বিএনপি, বাম জোট এবং আরও অনেকে নির্বাচনে আসেনি, তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। বলতে গেলে শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ফাঁকা মাঠ। সব খেলোয়াড় নিজেদের। কিন্তু তবুও এই খেলায় ফাউলের অন্ত নেই।
হুমকি-পাল্টাহুমকি তো আছেই, এলাকা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে প্রার্থীদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব সহিংস কথাবার্তা। বোমা-গুলি, আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে খুন-জখম-সহিংসতার কোনো ধরনের প্রকাশই বাকি নেই।
প্রায় সব প্রার্থীই আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী লীগের অনুগত। নির্বাচনে ৩০০ আসনে শেষ পর্যন্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৯৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আছে ২৬৩ আসনে। দলটির আরও ২৬৯ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন; যারা ইতোমধ্যে আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে পরিচিতি পেয়েছেন। ২৮ জন বর্তমান সংসদ সদস্যও রয়েছেন, যারা এবার দলের মনোনয়ন পাননি। অর্থাৎ ৩০০ আসনে শাসক দলেরই প্রার্থী ৬০০-এর ওপরে। এদের সবারই আওয়ামী লীগের পদ-পদবি আছে, এলাকায় আধিপত্য আছে, শক্তি দেখানোর মতো সামর্থ্য আছে।
যারা নৌকা প্রতীক পেয়েছেন আর দলের হয়ে যারা নৌকা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের দ্বন্দ্ব এখন শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। ভোটের মাঠে নৌকা বনাম স্বতন্ত্র শত্রুতা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দলীয় কৌশল ছিল যেহেতু বিএনপি আসছে না, তাই ভোটার উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে। তাই দলের নেতাদের উৎসাহিত করা হয়েছিল স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে। আরেকটা বড় উদ্দেশ্য ছিল কেউ যেন ২০১৪-এর মতো বিনাভোটে এমপি হতে না পারে এবং ভোটের মাঠে একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকে।
সেই পরিবেশ আনতে গিয়ে পুরো নির্বাচনী মাঠই এমন সংঘাতময় হয়ে পড়বে সেটা হয়তো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চিন্তাও করতে পারেননি। নিজেদের মধ্যে একটি নির্বাচনও সুন্দরভাবে করতে পারছেন না তারা। একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, ভোটের এই সংঘাত থেকে সৃষ্ট বিরোধ সারাদেশে দলের অভ্যন্তরে স্থায়ী বিরোধ ও বিভেদের পরিস্থিতি তৈরি করবে। সাধারণ ভোটাররা তো দূরের কথা, ভোট দেওয়া নিয়ে আতঙ্কে আছেন এখন দলের ভোটকর্মীরাই।
ভোটের এমন এক পরিবেশে নির্বাচন কমিশন কী করছে সেটাই এখন জিজ্ঞাসা। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। কারণ তারা আশঙ্কা করেছিল যে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তারা পাবে না। এখন তো দেখা যাচ্ছে কমিশন বিএনপি ছাড়াই সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে পারছে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোথাও কোথাও মাঠে দাঁড়াতেই পারছেন না, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী অনেকেই আচরণবিধি মানছেন না। এমন সব অভিযোগ ক্ষণে ক্ষণে আসছে ভোটের মাঠ থেকে। আবার দু-একটি জায়গায় এমন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন যে, নৌকার প্রার্থীকেও মাঠছাড়া করতে তৎপর। যেমন ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী জাফরউল্লাহ তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর অভিযোগ করছেন। নিক্সন আবার যুবলীগেরও নেতা।
সারাদেশে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রেষারেষি সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম তাগিদ দিচ্ছে, কমিশন নিজেও বুঝতে পারছে কঠোর হতে হবে। কিন্তু এখনো তা দৃশ্যমান নয়।
এ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে- এর মধ্যে শুধু সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় কুমিল্লা-৬ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ইসি। এ ঘটনার তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হযনি এখনো। আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। তারা দুজনই বর্তমানে সংসদ সদস্য। এ ছাড়া বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনে তলবের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে কবে ডাকা হবে, তা এখনো নির্ধারণ হয়নি।
কমিশন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করতে পারায় নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে সহিংসতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সহিংসতা বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু কমিশন মনে হচ্ছে কোথাও না কোথাও দ্বিধায় আছে। মাঠ প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেক কথা উঠছে যে, এই সংঘর্ষ ও সংঘাতের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নৌকা প্রার্থীদের পক্ষে থাকছে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো উত্তাপ নেই, আছে কেবল শাসক দলের ভেতর উত্তেজনা।
নির্বাচন কমিশনের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া আছে আরপিও অনুযায়ী। কিন্তু তার প্রয়োগ দেখছি না আমরা। প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার উচিত ছিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। সেটা হচ্ছে না। এর পরিবর্তে ইসি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে যা সময়ক্ষেপণ করছে। শোকজের গৎবাঁধা জবাব দিয়ে প্রার্থীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
ভোটের মাঠে বিএনপি নেই, অথচ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বড় ধরনের চাপ ও চ্যালেঞ্জে পড়েছে কমিশন। সরকারবিরোধীদের বর্জন ও ভোট ঠেকানো ছাড়াও সারাদেশে প্রার্থীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণ করে শেষ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ ঠিক রেখে ভোটের হার বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে যদি এখনই সহিংসতার রাশ টেনে ধরা না যায়।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
Leave a Reply