মাগুরায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৮ সালে। মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের একটি অংশে ৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে মেডিকেল কলেজটি ২০১৯ সালে যাত্রা করলেও এখনো স্থায়ী ঠিকানা পায়নি। সম্প্রতি সদর উপজেলার গোয়ালখালী ও পারলা এলাকায় ২৫ একর ফসলি জমিতে কলেজটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে কোনো ফসলি জমিতে নতুন প্রকল্প না নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকার প্রধানের।
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রমতে, মাগুরা মেডিকেল কলেজটির অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কমিশনে। প্রস্তাবে জমি অধিগ্রহণ, ১৫টি আবাসিক, ১০টি অনাবাসিক ভবন নির্মাণ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। স্থান নির্বাচন করা হয়েছে সদর উপজেলার গোয়ালখালী ও পারলা এলাকায়। মোট ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪ কোটি টাকা। নির্ধারিত সেই জমিতে এখন বছরে তিনটি ফসল চাষ হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। এমনকি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়েও স্থান নির্বাচনকে প্রকল্পটির দুর্বলতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জমিটিকে দ্বিফসলি কৃষিজমি ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ নিম্নাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লাল ক্যাটাগরির এ প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেয়া হয়নি।
প্রস্তাবিত এলাকাটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোথাও রোপণ করা হয়েছে বোরো ধান কোথাও বিভিন্ন রবিশস্য, পেঁপে, কলা, করলাসহ সবজি আবাদ করা হয়েছে। পাশেই মসুর ডাল কাটছিলেন চাষীরা। এখানে তিন ফসল চাষাবাদ করা হয় জানিয়ে স্থানীয় কৃষক সোনা শেখ আজকের মাগুরাকে বলেন,এসব জমিতে ধান, পাট ছাড়াও মসুর ডাল, কলা, পেঁপে ও রবিশস্য আবাদ করা হয়। এখন ধান লাগানো আছে। পরে আবার করলা লাগানো হবে। করলার পর আবার ধান আবাদ করা হবে। অর্থাৎ পাট, ধান ও সবজি মিলিয়ে তিনটি ফসল হয় এখানে।
মেডিকেল কলেজ নির্মাণের কথা জানার পর সেখানকার জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে জানান স্থানীয় আরেক কৃষক আরজ আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘আগে জমির দাম শতাংশপ্রতি ছিল ১ লাখ টাকার মতো। কিন্তু মেডিকেলের নাম শুনে এখন ৪-৫ লাখ টাকা হয়ে গেছে। কারণ সরকার নাকি তিন গুণ ক্ষতিপূরণ দেবে।’
এদিকে তিন ফসলি জমিতে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো ধরনের প্রকল্পই হাতে নেয়া যাবে না বলে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ওই নির্দেশনার কথা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হিসেবে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে বলে তখন জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এরপর কয়েকটি একনেক সভায়ও একই কথা বলেছিলেন সরকারপ্রধান। অথচ সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না মাগুরা মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ সারোয়ার হোসাইন বলেন, ‘জায়গা পরিবর্তন হলে প্রকল্প দুই বছর ঝুলে যাবে। কারণ তখন আবার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। তাই পরিকল্পনা কমিশন থেকেই প্রকল্পটির বিষয়ে খুব বেশি প্রচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা দ্রুতই প্রকল্পটি একনেকে যাওয়ার কথা রয়েছে।’
জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্য উইংয়ের যুগ্ম প্রধান মো. মায়সুর মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের কাজ জেলা প্রশাসক অফিস থেকে করা হয়। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নির্দেশনার আলোকেই কাজ করব আমরা। এসব জমিতে প্রকল্প করার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিধিনিষেধ থাকলে অবশ্যই সেখানে প্রকল্প হবে না।’
এদিকে প্রকল্পটির ক্রয় পরিকল্পনায়ও বেশকিছু অসংগতি পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্প প্রস্তাব ও ক্রয় পরিকল্পনার তথ্য মিলছে না। ১ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকার ক্রয় পরিকল্পনা করা হলেও প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার। এছাড়া প্রকল্পটি লাল শ্রেণীভুক্ত হওয়ায় অনুমোদনের আগে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেটি এখনো করা হয়নি। এছাড়া গাড়ি কেনা, তেল ও মেরামেত ব্যয় বাদ দিতে বলা হয়েছে। আসবাব ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনায়ও ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরার সিভিল সার্জন ডা. মো. শামীম কবির বলেন, ‘প্রি-একনেক পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে গত সপ্তাহে। ২৫ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে প্রকল্প অনুমোদন হলে সেই জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে।’
মাগুরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মো. কামরুল হাসান বলেন, জমি অধিগ্রহণ না হলেও পূর্ববর্তী সব কাজ শেষ। কারণ প্রশাসনিক অনুমোদন হয়ে গেছে। এখন প্রকল্প পাস হলে টাকা দিয়ে অধিগ্রহণ করা হবে।’ তবে কৃষিজমির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কৃষিজমি নষ্ট না করার জন্যই ৫০ একরের জায়গায় ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তাই ভবনগুলো ১০ তলা করা হবে।’
কৃষিজমিতে মেডিকেল কলেজ নির্মাণের বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. কাজী আফজালুর রহমান। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা মো. আব্দুস সালাম খান ও দেশের বাইরে থাকায় এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
Leave a Reply